
মিজানুর রহমান, গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি:
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে যখন জাতি গভীর শ্রদ্ধায় বীর শহীদদের স্মরণ করছে, তখন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে দেখা যাচ্ছে এক ভিন্ন চিত্র। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যে বীরদের আত্মত্যাগে স্বাধীনতা এসেছিল, তাঁদের স্মৃতিচিহ্নই আজ চরম অবহেলায় ঢাকা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতীক কাটাখালী ব্রীজের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি বর্তমানে অযত্ন আর অবহেলার শিকার।
১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর রসদ ও যুদ্ধাস্ত্র বহনে বাধা দিতে গোবিন্দগঞ্জের দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাটাখালী ব্রীজটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ হাতুড়ি, কোদাল নিয়ে ব্রীজের অংশবিশেষ ভেঙে দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই সময়ে পাকসেনাদের কনভয় এসে অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করলে ঘটনাস্থলেই বেশ কয়েকজন শহীদ হন। এই বীর আত্মদানকারী ১১ জন শহীদের নাম আজও স্মৃতিস্তম্ভটিতে খোদাই করা আছে।
বিজয়ের প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পরেও, এই ঐতিহাসিক স্থানটির করুণ দশা চোখে পড়ার মতো। সরেজমিনে দেখা যায়, ১১ জন বীরের নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভটি চারপাশ থেকে জঙ্গল আর আগাছায় ঢেকে গেছে। ধুলো-বালিতে মাখামাখি হওয়ায় এর শ্বেতশুভ্র কাঠামো এখন মলিন। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি তার সকল জৌলুস হারিয়েছে।
স্থানীয় প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন মহল এই দৃশ্য দেখে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, “আজ কোনো মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। অথচ দেশের জন্য সরাসরি জীবন উৎসর্গকারী বীরদের এই স্মৃতিস্তম্ভটি কেন বছরের পর বছর ধরে এমন অবহেলিত থাকবে? শহীদদের প্রতি আমাদের কি এটাই সম্মান জানানোর ভাষা?”
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা কেবল একটি দায়িত্ব নয়, এটি জাতির পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদর্শনের নৈতিক অঙ্গীকার। বর্তমান প্রজন্ম যেন সঠিক ইতিহাস জানতে পারে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, তার জন্য এই পবিত্র স্থানটির মর্যাদা রক্ষা করা অত্যাবশ্যক।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং উপজেলা প্রশাসনের প্রতি স্থানীয় জনগণ তাই জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন। অবিলম্বে স্মৃতিস্তম্ভটি পরিচ্ছন্ন, জঙ্গলমুক্ত এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় এনে শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমাকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানানো হচ্ছে। বিজয়ের মাসে এই অবহেলার চিত্র মুছে দিয়ে জাতি যেন সত্যিকারের শ্রদ্ধার নিদর্শন স্থাপন করতে পারে।